একসময় যে ইন্ডাস্ট্রিতে এক পয়সা খরচ করাকেও অপচয় মনে হতো, যাকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল কয়েকবার, বর্তমানে সেই ইন্ড্রাস্ট্রির শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের বাজারই বছরে কয়েক কোটি ডলার। ধারণা করা হচ্ছে সারা পৃথিবীজুড়ে ৪০ কোটি মানুষেরও বেশী ব্যবহৃত এই পডকাস্ট ইন্ডাস্ট্রি আগামীতে টক্কর দেবে নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইমের মত ওটিটি প্লাটফর্মকেও। পডকাস্টিং করতে গিয়ে নবীন পডকাস্টাররা শুরুতে যে ভুলগুলো করে থাকেন সেগুলো নিয়েই আজকের লেখা।

২০২০ এর ডিসেম্বর। বছর দেড়েকের একজন বাচ্চার কথা প্রথমবারের মতো শোনা যাবে পডকাস্টে। এমনিতে নিতান্ত মামুলি ঘটনা মনে হলেও কয়েক কোটি উৎসুক শ্রোতার ভীড়ে অডিও স্ট্রিমিং জায়ান্ট স্পটিফাইয়ের তখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। শ্রোতাদের চাপে একটু পরপরই জট লেগে যাচ্ছে সার্ভারে। যার কন্ঠ শোনা নিয়ে এই অনলাইন যুদ্ধ, তার নাম আর্চি। ব্রিটিশ রাজপরিবারের সাবেক উত্তরসূরী হ্যারি-মেগান দম্পতির প্রথম সন্তান।

রাজপরিবার ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়ার পর হ্যারি-মেগান দম্পতি প্রতিষ্ঠা করেন আর্চওয়েল নামের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তারই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘আর্চওয়েল অডিও’র সাথে এক্সক্লুসিভ চুক্তি করে অডিও স্ট্রিমিং জায়ান্ট স্পটিফাই। আর্চওয়েল অডিওর প্রযোজনায় সেবছরই স্পটিফাইতে প্রকাশিত হয় হ্যারি-মেগান দম্পতির যৌথ পডকাস্ট, যা এখনো পর্যন্ত পডকাস্টের ইতিহাসের সর্বাধিক শ্রুত কয়েকটি প্রোগ্রামের মধ্যে একটি। যেখানে তারা মন খুলে বলেন তাদের জীবনের বহু অজানা কথা, বৈঠকি আড্ডায় এনে হাজির করেন স্যার এলটন জন, নাওমি ওসাকা, দীপক চোপড়া, জেমস কর্ডেন এবং টায়লার পেরির মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের।

শুধু হ্যারি মেগানই নন, পডকাস্টের মাধ্যমে বর্তমানে দুনিয়া দাপড়ে বেড়াচ্ছেন ধনকুবের বিল গেটস থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, সেলিব্রেটি উপস্থাপক অপরাহ্‌ উইনফ্রে থেকে শুরু করে বলিউডের কারিনা কাপুর খান, নেহা ধুপিয়া, করণ জোহর এমনকি খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত।

২০১৪’র অক্টোবর থেকে ২০২১ এর নভেম্বর পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদির “মান কি বাত” (মনের কথা) এর মোট ৮৩টি পর্ব প্রচারিত হয়েছে আকাশবানী এবং দূরদর্শন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। যা মুহূর্তেই পৌছে গেছে ভারত ও তার বাইরের কোটি কোটি ঘরে এবং এর প্রভাবও ছিল সুদূরপ্রসারী। এমনকি ‘মান কি বাত’ ভারতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে বলে কয়েকদফা নির্বাচন কমিশনে অভিযোগও করে বিরোধীপক্ষ।

ই-মার্কেটারের প্রকাশিত তথ্যমতে বর্তমানে সারা পৃথিবীজুড়ে পডকাস্ট ইন্ডাস্ট্রির বাজার প্রায় ৪২.৪২ কোটি ডলার, যা ২০১৯ সালেও ছিল মাত্র ২৭.৪৮ কোটি ডলার। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৪ সাল নাগাদ পডকাস্ট ইন্ডাস্ট্রির বাজার ৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে এবং ২০২৮ সাল নাগাদ এটি ১০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌছে যাবে বলেও আভাস দিয়েছে ই-মার্কেটার।

দিনে দিনে পডকাস্টের বাজার যতোটা বাড়ছে ঠিক ততটাই বাড়ছে এর কন্টেন্টের পরিমাণও। ২০২০ সালে প্রায় ৭ লাখের মতো পডকাস্ট হলেও ২০২১ এ এসে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে আট লাখে। বর্তমানে পডকাস্টের মোট কন্টেন্টের পরিমান প্রায় পাঁচ কোটির মতো এবং প্রতি বছর এর কন্টেন্টের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে।

পডকাস্টের এই জনপ্রিয়তার কারণে অনলাইন রেডিও বা স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলোর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও পডকাস্ট প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে গুগল অধিকৃত ইউটিউব এবং ফেসবুকের অডিও রুমের মাধ্যমেও পডকাস্ট প্রচার করা যাচ্ছে। এতে করে যে কোন কন্টেন্ট যেমন খুব দ্রুত বিপুল পরিমাণ শ্রোতার কাছে পৌছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে ঠিক তেমনি বিনা খরচে, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্রাউজ করতে করতেই শ্রোতারা তাদের পছন্দের পডকাস্ট শোনার আনন্দ নিতে পারছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পডকাস্ট প্রচারের এই সুযোগ আকৃষ্ট করছে নানা বয়সের নানা পেশার মানুষদের। অনেকেই এখন উদ্যোগী হচ্ছেন নিজ কমিউনিটিতে কিংবা বন্ধুমহলে পডকাস্ট ধারণ এবং প্রচার করতে। তবে নতুন অবস্থায় পডকাস্ট করতে গিয়ে প্রায়শই কিছু ভুল হয়ে থাকে যা সঠিক সময়ে শুধরে না নিলে পরবর্তীতে প্রকট আকার ধারণ করে।

পডকাস্টিংয়ের সবচেয়ে বেশী করা ৭টি ভুল, যা একটু সতর্ক হলেই এড়িয়ে চলা সম্ভব সেগুলো হলো;

১. সর্বসাধারণের জন্য কন্টেন্ট বানানো

মূলধারার যে কোন গণমাধ্যমের চেয়ে পডকাস্ট অনেকটাই আলাদা। মূলধারার গণমাধ্যমে যেখানে টার্গেট থাকে আধেয়টিকে যতটা সম্ভব বেশী মানুষের কাছে পৌছানোর, পডকাস্টের বেলায় বিষয়টি ঠিক উল্টো। পডকাস্ট সবসময় প্রচার করা হয় একটি নির্দিষ্ট ঘরাণার শ্রোতার জন্য। এটি একটি বিশেষায়িত মাধ্যম, যেখানে শ্রোতারা তাদের পছন্দের বিষয়ে আরও গভীরভাবে জানতে ও বুঝতে পারেন। বিষয়টি তুলনা করা যায় অনেকটা ডাক্তার দেখানোর মতো। সাধারণ জ্বর, সর্দির জন্য আমরা হয়তো একজন এমবিবিএস ডাক্তারেরই পরামর্শ নেবো, কিন্তু যদি আমাদের হার্ট বা কিডনি বিষয়ক কোন রোগ হয় সেক্ষেত্রে আমরা সবাই চাইবো যেন সেই বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরই পরামর্শ নিতে। পডকাস্টই ঠিক তেমনই। আর তাই পডকাস্ট করার আগে কোন বিষয়ের উপর পডকাস্টটি হবে তা নির্ধারণ করা সবচেয়ে জরুরী।

২. নিজের শ্রোতাদেরকে বুঝতে না পারা

একজন পডকাস্টারের জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব ঠিক ততটাই বাড়বে যতটা তিনি তার শ্রোতাদেরকে বুঝতে পারবেন। শ্রোতারা তার কাছে কি চায়, তারা কি জানতে চায়, তারা কি শুনতে চায়, একজন ভালো পডকাস্টার পডকাস্টিং এর আগে অবশ্যই সেই জিনিসগুলো মাথায় রাখবেন এবং সেই অনুযায়ীই তার কন্টেন্ট সাজাবেন।

৩. রাতারাতি সাফল্য আশা করা

যে কোন ভালো কাজের জন্য দরকার পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে লেগে থাকার মানসিকতা। এক্ষেত্রে রাতারাতি সাফল্য আশা করলে অনেক সময় তা হিতে বিপরীত হয়ে দাড়ায়। আর তাই পডকাস্ট শুরু করার আগেই প্ল্যান করতে হবে যে শ্রোতাদের এই অনুষ্ঠানের প্রতি মনোযোগী করে তুলতে কতটা সময় প্রয়োজন, তার জন্য কী কী করা যেতে পারে, কাকে কাকে অতিথি হিসেবে আনা যায় এর বিস্তারিত পরিকল্পনা। আগে থেকেই মানসিক প্রস্তুতি এবং প্ল্যান করতে পারলে মাঝপথে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা যেমন কমে যায় তেমনি দীর্ঘমেয়াদের জন্য সঠিক সময়ে সঠিক প্রস্তুতিও গ্রহণ করা যায়।

. গবেষণা ও মার্কেটিং প্ল্যান না থাকা

বেশীরভাগ পডকাস্টারই পডকাস্টিং শুরু করেন শখের বসে। আর শখের বসে শুরু করা এই পডকাস্টিংগুলো অনেকক্ষেত্রেই স্বল্প আয়ুর হয়ে থাকে। এর মূল কারণ হলো গবেষণার অভাব এবং সঠিক মার্কেটিং প্ল্যান না থাকা। তাই পডকাস্টিং শুরুর আগেই প্ল্যান করতে হবে গবেষণার ও এর যথাযথ মার্কেটিংয়ের। এতে করে অনুষ্ঠানটি যেমন সঠিক শ্রোতাদের মাঝে দ্রুত সময়ে পৌছে দেয়া যাবে তেমনি পডকাস্টারও শ্রোতাদের মনোভাব, মেজাজ এবং চাহিদা সম্পর্কে আগাম ধারণা নিয়ে সেই অনুযায়ী পরবর্তী প্রোগ্রামগুলো সাজিয়ে নিতে পারেন।

৫. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মার্কেটিং না করা

যেহেতু পডকাস্টিং একটি শ্রুতিমাধ্যম, তাই অনেক পডকাস্টারই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর প্রচারণাকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বর্তমানে শুধুমাত্র যোগাযোগেরই প্রধাণতম মাধ্যম নয়, মার্কেটিংয়ের এবং বিপণনেরও সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম। আর তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সঠিক প্রচারণা শ্রোতার হার দ্রুত বৃদ্ধি এমনকি গাণিতিক হারেও বাড়াতে সক্ষম। এক্ষেত্রে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট, টিকটক থেকে শুরু করে সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সক্রিয় থাকাটা খুবই জরুরী।

৬. কপিরাইট লঙ্ঘন করা

নবীন পডকাস্টাররা শুরুতেই সবচেয়ে বড় যে ভুলটি করেন তা হলো কপিরাইট আইন লঙ্ঘন। অনেকেই মনে করেন ২-৩ সেকেন্ডের এই মিউজিক বা গানটি যদি আমি আমার প্রোডাকশনে ব্যবহার করি তাহলে কেউ হয়তো খেয়াল করবে না বা ধরতে পারবে না। এই পদ্ধতিতে শ্রোতাদের ফাঁকি দেয়া গেলেও বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে খুব সহজেই এই কন্টেন্টগুলো ধরে ফেলা যায়। স্ট্রিমিং সাইটগুলো একারণে আপনাকে কালো তালিকাভুক্তও করতে পারে। তাই কপিরাইটভুক্ত যে কোন কন্টেন্ট অননুমোদিত ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর একান্তই যদি ব্যবহার করতে হয় তাহলে যথাযথ পদ্ধতি অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা অথবা কপিরাইট ফ্রি কন্টেন্ট ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো।

৭. মনিটাইজেশনে গুরুত্ব না দেয়া

একসময় শখ থেকে শুরু করলেও পডকাস্টিংয়ের আকার যখন বাড়ে তখন তার খরচ, গবেষণা ও শ্রমের কলেবরও বৃদ্ধি পায়। অনেকে একে একসময় মূল পেশা হিসেবেও গ্রহণ করেন। ফলে শুরু থেকেই মনিটাইজেশন বা অর্থ আয়ের চিন্তা না করলে পডকাস্টারদের অর্থনৈতিক ঝুঁকি থেকেই যায়। তাই পডকাস্টিংয়ের একেবারে শুরু থেকেই যদি একে মনিটাইজেশনের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে ভবিষ্যতের এই অর্থনৈতিক ঝুঁকিও সহজেই এড়ানো যায়।

বাংলাদেশে পডকাস্টিং এখনও একটি উদীয়মান প্ল্যাটফর্ম। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় পডকাস্ট এবং পডকাস্টারের সংখ্যা দিন দিন আনুপাতিক হারে বাড়লেও আমাদের দেশে এই প্রভাব এখনও খুব সীমিত। তবে এখন থেকেই সঠিক উদ্যোগ নিয়ে এবং ভুলত্রুটি এড়িয়ে চলতে পারলে আমাদের দেশেও পডকাস্টিংয়ের বিশাল বাজার রয়েছে।

লেখক: মো. সাইদুর রহমান খান, প্রভাষক, সাংবাদিকতা, মিডিয়া ও যোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।