শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। মানুষ যদিও তার গভীর আবেগ এবং ভালোবাসা থেকেই এই পেশা গ্রহণ করে থাকেন এবং শিক্ষার্থীদেরকে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যান, তবুও প্রকৃতপক্ষে তিনি শিক্ষক হিসেবে কতটুকু সফল তা জানার জন্য এর মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।ফল স্বরূপ, একজন শিক্ষক উপলব্ধি করতে পারেন এই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে তিনি কতখানি সফল কিংবা তার ব্যর্থতাই বা কতটুকু। তাই শিক্ষকতার মূল্যায়ন ফলপ্রসূ শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তাতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।

নানাভাবেই শিক্ষকতার মূল্যায়ন করা যায়। তার মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আজকে আমি আলোকপাত করব।

১। শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত ফলাফল দ্বারা মূল্যায়ন
২। সহকর্মীদের দ্বারা মূল্যায়ন
৩। শিক্ষার্থীদের দ্বারা সরাসরি মূল্যায়ন এবং
৪। আত্ম মূল্যায়ন

 

১। শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত ফলাফল দ্বারা মূল্যায়নঃ বাংলায় একটি কথা আছে “বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়” শিক্ষক হিসেবে একজন ব্যক্তি কতটা সার্থক তা নির্ভর করছে কি পরিমান শিক্ষার্থীকে তিনি সফলতার মুখ দেখাতে পেরেছেন। ধরা যাক, তার  সমস্ত শিক্ষার্থীর ভিতরে ৮৫% শিক্ষার্থী খুব ভালোভাবে পাশ করেছে। অতএব, পরিসংখ্যান এর দিক দিয়ে  তিনি একজন সফল শিক্ষক। তবে, বাস্তবতায় পরিসংখ্যানও অনেক সময় ভাল ফলাফল আনে না। এই যেমন, এক ব্যক্তি একটি নদী পার হতে গিয়ে দেখলেন পাশের একটি নোটিশ বোর্ডে পানির গভীরতার পরিমাপ দেওয়া আছে। নদীতে দুই পাশে পানির গভীরতা শুন্য,পরের বাকি দুই জায়গায় এক ফুট এবং ঠিক নদীর মাঝখানে পানির গভীরতা তিন ফুট। এবার উনি পরিসংখ্যানের ভাষায় হিসেব করে দেখলেন নদীতে পানির গড় গভীরতা এক ফুট।  তাহলে তো কাপড় না ভিজেই নদী হেঁটে পার হওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নদীর মাঝখানে গিয়ে তিনি কাপড় ভিজিয়ে ফেললেন। কারণ, সেখানে তো পানির  প্রকৃত গভীরতা ছিল তিন ফুট।  এবার দেখুন, ৮৫% শিক্ষার্থীকে সফলতার মুখ দেখালেও অবশিষ্ট ১৫% শিক্ষার্থীকে কিন্তু সফলতার মুখ দেখা দেখানো সম্ভব হয়নি।

সুতরাং, শিক্ষকতায় এই মূল্যায়নের মাধ্যমে আমরা অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদেরকে যেমন খুঁজে বের করতে পারছি তেমনি তাদের প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়ারও সুযোগ পাচ্ছি। ফলে ক্লাস টেস্ট, অ্যাসাইনমেন্ট,  প্রেজেন্টেশন, মিডটার্ম কিংবা ফাইনাল পরীক্ষায় যেন তারা ভালো করে সে বিষয়ে তখন বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে পারছি। পাশাপাশি কোন বিষয়ের উপরে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন তৈরি করে ক্লাস শুরুর আগে প্রিটেস্ট এবং ক্লাস শেষে পোস্ট টেস্ট এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ফলাফল  যাচাই করতে পারছি এবং পরিসংখ্যান এর মাধ্যমে আমরা বের করে নিতে পারছি কাদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে ভাল ফলাফল অর্জনের জন্য। তবে শিক্ষার্থীদের ভিতরে এমন অনেকই রয়েছে যারা সহজে কোনো দিকনির্দেশনা পালন করতে চায় না। আর তাদের মানসিক অবস্থাটা অনেকটাই নিচের গল্পের দাদার মতো।   গল্পটি হল- দাদা-নাতি একসঙ্গে ওয়াজ শুনতে গিয়েছে। ওয়াজের এক পর্যায়ে হুজুর বললেন যে হাঁটুর উপরে কাপড় উঠলে তখন গুনাহ হয়। ওয়াজ শেষে বাড়িতে যাওয়ার পথে ছোট্ট একটা খাল রয়েছে যেখানে খালের পানি অনেকটাই হাঁটুর উপরে। নাতি এবার দাদাকে বলল “দাদা, আমার পরনের কাপড় যে ভিজে যাচ্ছে!” দাদা বললেন, “ভিজবে কেন? শক্ত করে কাছা মার, কাপড় ভিজবে না।” “কিন্তু হুজুর যে বললেন হাঁটুর উপরে কাপড় উঠলে গুনাহ হবে!” নাতির এ কথায় দাদা তখন আস্তে করে নাতির গালে একটা চড় মেরে বললেন, “আমি বাহাত্তর  বছর ধরে ওয়াজ শুনছি কিন্তু সে ওয়াজ কোনদিন বাড়িতে নিয়ে গেলাম না, আর একদিন ওয়াজ শুনেই তুই বাড়িতে নেওয়া শুরু করেছিস। নে শক্ত করে কাছা মেরে নদী পার হয়ে যা।” তাই দিক-নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সেটা আবার সঠিকভাবে পালন করছে কিনা সে বিষয়েও আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে।

২।   সহকর্মীদের দ্বারা মূল্যায়নঃ প্রচলিত একটি কথা আছে “প্রদীপের গোড়ায় অন্ধকার” একটা প্রদীপ চারিদিকে আলোকিত করে রাখে কিন্তু তার নিজের গোড়ায় আলো দিতে পারে না। তবে হ্যাঁ, যদি ওটার পাশাপাশি আরেকটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া যায় তাহলে একটি অপরটির গোড়ার  অন্ধকারকে সুন্দরভাবে আলোকিত করে দেয় শিক্ষকতার মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও আমরা এর উপযুক্ত ব্যবহার দেখতে পাই। একজন শিক্ষকের কোনগুলো সবল দিক কিংবা কোথায় তার আরও উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে তা অনেক সময় তিনি নিজে বুঝতে পারেন না । কিন্তু তার ক্লাসে গিয়ে আরেকজন শিক্ষক যদি সেগুলো অবলোকন এবং পর্যালোচনা করেন তাহলে সুন্দর ভাবে তা চিহ্নিত করে দিতে পারেন।  ফলশ্রুতিতে একজন শিক্ষক খুব সহজেই তার সহকর্মী দ্বারা মূল্যায়নের মাধ্যমে নিজেকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন পরিপূর্ণ শিক্ষক হিসেবে। যার ফলাফল শিক্ষার্থীদের জীবন গড়ার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে আমার বিশ্বাস।

৩। শিক্ষার্থীদের দ্বারা সরাসরি মূল্যায়নঃ এর মাধ্যমে একজন শিক্ষক নিজের অবস্থানটা সুন্দরভাবে নির্ণয় করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কিছু প্রশ্ন পত্র তৈরি করে শিক্ষার্থীদের দিতে পারেন যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে শিক্ষককে মূল্যায়ন করবে। ফলে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে নিজের অবস্থান সহজেই নির্ধারণ করতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায়, একজন শিক্ষক নিজের মনে যেটাকে সঠিক ভাবছেন বাস্তবে সেটা সঠিক নাও হতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের দ্বারা মূল্যায়নের মাধ্যমে সঠিক ব্যাপারটা সবার সামনে উম্মোচিত হয়।  এ বেপারে একটি গল্প বলি -একদা এক সিংহ একটি ছোট্ট খরগোশকে ধাওয়া করলো। খরগোশটি দৌড়াতে দৌড়াতে একটি ছোট্ট ঝোপের কাছে গিয়ে সেখানে ঝোপের ভিতরে নিজের মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে চোখ খুলে দেখল যে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তখন সে ভাবল আমি যেহেতু কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা সুতরাং আমাকে সিংহও দেখতে পাচ্ছে না। অথচ একটু পরেই সিংহটা এসে খরগোশটাকে খপ করে ধরে গপ করে গিলে ফেলল।

সুতরাং শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে মিল রেখে তাদের দ্বারা নিজেকে মূল্যায়ন করে একজন শিক্ষক নিজেকে সফল শিক্ষক হিসেবে সবার সামনে আরো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।

৪।   আত্ম মূল্যায়নঃ যে সব শিক্ষার্থী পরিক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারে না তাদের বেলায় এসে আমাদের সহজেই হাল ছেড়ে দেওয়া উচিৎ নয়।  কারণ, বাস্তবতায় তাদেরও অনেক সবল দিক রয়েছে।  তাই তাদের দুর্বল দিকগুলোকে পরিচর্যার পাশাপাশি  সবল দিকগুলোকে খুঁজে বের করে সেটাকে কাজে লাগিয়ে সফলতার স্বর্ণ শিখরে  তাদেরকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।

উদাহরণ হিসেবে বলি- এক রাজার ছিল একটা কানা আর একটা পা খোঁড়া। কিন্তু তার খুব সখ নিজের একটা ছবি আঁকাবেন। দেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের ডাকলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন তার একটা ছবি এঁকে দিতে কিন্তু চিত্রশিল্পীরা কেউ রাজি হলেন না। আসলে ছবি আঁকতে সাহস হল না কারো। সাহস হবেই বা কীভাবে? রাজার এক চোখ নেই।এক পা নেই। কেমন করে তার সুন্দর ছবি আঁকা যাবে? আর আঁকা গেলেও সে ছবি সুন্দর হবে না। খুঁত থাকবেই। রাজা তখন নিশ্চয় ভীষণ চটে যাবেন। গর্দান নেবেন শিল্পীর। কে আর সাধ করে প্রাণ হারাতে চান!

রাজা অন্য দেশের শিল্পীদের বললেন তার সুন্দর একটা ছবি এঁকে দিতে। তারাও কেউ রাজি হলেন না। রাজার খুব মন খারাপ হয়ে গেলো। তাহলে কি তার সখ পূরণ হবে না? রাজা হতাশ হয়ে পড়লেন। এমন সময় এক চিত্রশিল্পী এসে জানালেন তিনি রাজার ছবি আঁকতে রাজি। শুরু হল ছবি আঁকা। অনেক ভেবেচিন্তে একটা ছবি আঁকলেন সেই শিল্পী। নিজের ছবি দেখে রাজা মুগ্ধ হলেন। মুগ্ধ হলেন উজির নাজির আর সভাসদরা সহ দেশের সবাই। রাজার এত সুন্দর ছবি! ছবিতে রাজা ঘোড়ার পিঠে বসে আছেন। পাশে এক পা ঝুলছে। বোঝাই যায় না অন্য পাশে আরেকটা পা নেই। এক চোখ বন্ধ করে তীর বাগিয়ে ধরেছেন সামনে। যেন শিকার করার জন্য নিশানা ঠিক করছেন।  অতএব, অন্যের দূর্বলতা আড়াল করে তার ভালো দিকগুলো তুলে ধরলে উত্তম কিছু পাওয়া যায়!

পরিশেষে, শিক্ষকতা নামক এই মহান পেশাটিকে নানাভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে ফলপ্রসূ করার ঢেউ জাগুক সকল শিক্ষকের মনে এবং প্রয়াস চলুক শিক্ষার্থীদের জীবনকে এগিয়ে দিতে ওই সফলতার বাতায়নে। কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ গল্পঃ সংগ্রহিত ও পরিমার্জিত

লেখক: ড. মোঃ সরোয়ার হোসেন , সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসী বিভাগ , ফ্যাকাল্টি অব অ্যা্লাইড হেলথ সাইন্সেস, ড্যাফোডিল স্মার্ট সিটি , ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি , ঢাকা, বাংলাদেশ