সময়ের সাথে দৌড়ে জীবনের রেলগাড়ি টা প্রতি নিয়ত এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে ছুটে চলেছে। প্রাক্তন সময়ের সঞ্চয় হিসেবে হৃদয়ে বাধাই করা থাকে শুধু  রঙিন দিন  গুলো। আমার ক্যাম্পাস জীবনের শুরু থেকে আজ অব্দি প্রতিনিয়ত নতুন মাত্রা হিসেবে হাজারো নতুন স্মৃতি যুক্ত হয়েছে। কখনো নতুন কিছু আবিষ্কারের আশায়, কখনো আনন্দ আড্ডায়,  কখনো মন ভার করা গল্পে,কখনো জীবনের বাস্তব বা কঠিন কোনো সত্যের সন্ধান পেয়ে নানা মাত্রিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এই ক্যাম্পাসে চলতে চলতে আমার কৈশোর মন কবে যেন যৌবনের পদার্পন করেছে কে যানে! আমার তারুণ্যের উত্তপ্ত রক্ত যে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদে মুখরিত হয়েছে আব্রারের মৃত্যু তে, কোটা সংস্কার বা সরক দূর্ঘটিনা রোধে, আমার ক্লান্ত মস্তিষ্ক বন্ধুর গল্পে মুখরিত হয়েছে যে ক্যাম্পাসে, বন্ধুর প্রেমের চিঠি পড়ে উচ্চস্বরে হেসেছি যেখানে বসে, প্রিয় শিক্ষকের হাসি মুখে দেওয়া উপদেশ শুনে ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সংগ্রাম করতে শিখেছি যে প্রাঙ্গনে, বাবাকে প্রথম আলিঙ্গন করে বাবার চোখে জল দেখেছিলাম যেথায় দাঁড়িয়ে বা প্রথম কোনো প্রিয় চোখের মায়ায় হারিয়ে প্রেম সাধনায় ডুব দিতে ইচ্ছা জেগেছিল যে ক্যাম্পাসে তার এক অংশ অবস্থিত ধানমন্ডিতে আর এক অংশ আশুলিয়াতে । ড্যাফোডিল ফুলের মতই সবুজে ঘিরে ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে চিরসবুজ এক কয়াম্পাস জীবন উপহার দিয়েছে।

আমার ক্যাম্পাস জীবন শুরু হয়েছিল নতুন বছরের প্রথম দিন, ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসের এক তারিখ সেদিন। রাজু স্যার চেয়েছিলেন বছরের প্রথম সকাল টা আমাদের উৎসর্গ করতে তাই ধানমন্ডি-৩২ এ একত্রিত হয়েছিলাম সকলে। দুই ঘন্টার পথ পারি দিয়ে ধানমন্ডি গিয়েছিলাম এই মানুষটির স্নেহ মাখা আমন্ত্রণে। এরপর আরও কত কত সকাল দৌড়ে ছুটেছি প্রিয় ক্যাম্পাসে প্রায় চারটি বছর ৮:৩০ এ প্রথম ক্লাস ধরতে। কখনো আসমা ম্যামের জন্য পথ হতে কুরিয়ে নিয়েছি ভোরের শিউলী, কখনো বা মিঠু স্যারের আর্ট অব লিভিং ক্লাসে সকাল সকাল হাজির হয়েছি সপ্তাহের ভালো কাজের লিস্ট হাতে। আমি বরাবরই ছিলাম একটু চুপচাপ শান্ত সভাবের মেয়ে। তবে এস্কেলেটরের পাশে বসে যখন বান্ধবীর গল্পে মন খুলে হেসেছি উচ্চস্বরে তখন অপর তালা থেকে অন্য ডিপার্ট্মেন্টের বান্ধবী এসে বলে, ‘তোর হাসি শুনে বুঝতে পারলাম তুই এখানে’। আমি আবিষ্কার করলাম আমার আর ভয় লাগছে না অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতে বা মিশতে। মনেহতে লাগলো আমার খুব আপন, খুব কাছের এ প্রাঙ্গন। সেই প্রথম ফাল্গুনে শাড়ি পরেছিলাম এই ক্যাম্পাসে, তারপর মেহেদী দিয়েছি বান্ধবীর রাঙা হাতে, শরতের পিঠা উৎসব আর বৈশাখের লাল সাদা পড়নে বার বার দলবেধে হেটেছি এই পথে। বাংলার সংস্কৃতি আর আমার বাঙালীয়ানায় বার বার মেতেছি সেথায়। ঔপনিবেশিক তত্ত্ব নিয়ে যেবার বিশাল এক আলোচনার আয়োজন হলো দেশ বিদেশের গুরুতের সমাবেশে, তারপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন হল যেবার সমগ্র এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলনে, সেবার একটাই লক্ষ ছিল আমাদের সমগ্র দলের অন্তরে, আমাদের ক্যাম্পাস যেন সকলের নয়ন কাড়ে! মনে পরে সেই রাত করে বাড়ি ফেরা, ভোরে গিয়ে কাজে লাগা সকল পরিশ্রমের ফল পেয়েছিলাম চ্যায়ারম্যান স্যারের আয়োজন করা ধন্যবাদ অনুষ্ঠানে, যখন সবুজ কার্পেটে মোরা লাল স্টেজ গড়া ক্যাম্পাসের রোফটপ টা আরও একবার সেজেছিল নানা রঙে শুধু মাত্র আমাদের একদল ছাত্রের উদ্দেশ্য। রাতের পরিষ্কার আকাশের নিচে নানা রঙের বাতিতে সেদিন আমরা একদল তরুণ তরুণী মেতেছিলাম নতুন উদ্দীপনায়, নতুন আগ্রহে, নতুন সফলতার পথে আগাবো বলে।

আমার কাছে ক্যাম্পাস মানে শুধু ডিটি-৫, সিএসি ভবন, একাউন্টস, ভিসি ভবন, রেজিস্টার ভবন, লাইব্রেরী বা ক্যান্টিন নয় আমার কাছে ক্যাম্পাসের অংশ ছিল ৩২ এর লেক আর রবীন্দ্রসরোবরও। মনে পরে কারো জন্মদিন এলেই, পাশের গলিতে একত্রে এক কাপ চা ট্রিট নিয়ে ছুটে চলতাম মুক্ত হাওয়ায় কেক কাটতে। আর আশুলিয়াতে যে আমার ক্যাম্পাসের আরেক টুকরো পরে আছে এর মায়ায় কতবার যে ছুটে এসেছি আমরা দলেবলে! মনে পরে সেই বনমায়ায় বসে যেবার শেষ আড্ডা দিয়েছিলাম করোনার আগে, সেবার বার বার বুকে হাহাকার হয়েছে, আবার কবে এভাবে সবার একত্রে দেখা হবে! তারুণ্য ঘেরা এই ক্যাম্পাস জীবনে সমাপ্তির ক্রান্তিকাল ঘনিয়ে আসছে ভেবে বন্ধুত্বের মায়ায় যেন নতুন করে বাধা পড়েছিলাম সেদিন সকলে। কৃত্তিম ঝর্ণার পানিতে একত্রে হেটে সেদিন শান্ত করেছিলাম পুরে যাওয়া হৃদয় কে।

আমার সবচেয়ে বেশি সময় কাটানো দুটি জায়গা যার কথা না বললেই না, তা ছিল ডিটি-৫ এর সাত তালার ল্যাব আর সমগ্র ভবন জুরে বিশাল সেই লাইব্রেরী যার প্রত্যেক তালায় আমি বিচরণ করেছি। ল্যাবে বসে ঘন্টা জুরে এসাইন্মেন্ট করা, গ্রুপ ওয়ার্কের কাজ আর তার মাঝে ব্যাস্ত সময়ে ১৫ মিনিটের চা বিরতি, এসবের মায়াও যে আমাকে এতটা বাধবে কখনো ভাবিনি। লাইব্রেরি তে বসে থাকতাম এক সাথে অথচ এক এক জন এক এক বই হাতে, কেও পড়ছে বিসিএস দিবে বলে, কেও ভাবছে সামনের ফাইনাল পরিক্ষা নিয়ে আর কেও আনমনা বসে আছে বন্ধু বা বান্ধবীর টানে, আহা কি সময় ছিল সে!

এই ক্যাম্পাস জীবনে সু্যোগ পেয়েছি কিছু দক্ষ মুক্ত চিন্তার মানুষ কে খুব কাছ থেকে দেখার, তারা আমার শ্রদ্ধেয় প্রিয় শিক্ষকগণ। বন্ধুরা প্রায়ই দুষ্টুমি করে বলতো আমি নাকি শিক্ষকদের কে কিভাবে যেন খুশি করে ফেলি তাই সকল শিক্ষকরা নাকি আমাকে বেশি ভালবাসে। সত্যি বলতে আমিও মাঝে মাঝে অবাক হতাম এটা ভেবে যে কি করে শিক্ষকরা এতটা আপন হতে পারে! আমি তো খুব ভালবাসার মত কিছুই করিনি কখনো! শুধু তাদের কথা গুলো খুব কাছ থেকে শুনেছি, তাদের আদর্শ কে অনুভব করার চেষ্টা করেছি এবং তাদের ভালবাসা মাখা উপদেশ গুলো কে প্রাণ ভরে গ্রহণ করেছি। তার বিনিময়ে এই মহৎ মানুষ গুলো আমার মত একজন সামান্য ছাত্রী কে শুধু টাকার বিনিময়ে শিক্ষা নিতে আসা একজন ছাত্রী না ভেবে, নিজের সন্তানের বা বোনের জায়গা দিয়েছেন, আপন ভেবেছেন এবং শিক্ষকতার মহৎ পেশাকে হৃদয় দিয়ে পালন করেছেন।

আমার ক্যাম্পাস জীবনের গল্প একদমই অপূর্ণ রয়ে যাবে যদি আমাদের প্রিয় হান্নান ভাই, ইব্রাহিম ভাই আর ক্যাম্পাসের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা গম্ভির দানব ভাইদের গল্প না লিখি এবারে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এই মানুষ গুলো সব সময় পাশে থেকে এই অচেনা ক্যাম্পাস কে আপন করতে সাহায্য করেছে। একদিন যখন ফোন পার্স সব হারিয়ে দেওলিয়া হয়ে মাথায় হাত দিয়ে হান্নান ভাই কে আমার অবস্থা জানালাম, তখন ঠিক জাদুকরের মত এই লোক আমার সব ফিরিয়ে এনে দিল প্রায় এক ঘন্টা পরে। ক্যাম্পাসের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলো যারা আমাদের জন্য কয়াম্পাস টা কে সুরক্ষিত রাখার জন্য গম্ভীর ভাব ধরে থাকে, তারা খুব মিষ্টি করে হাসতে জানে। যদিও শুরুর দিকে কিছুটা ভয় হত, মনে হত তারা হাসতে জানেনা তবে সময়ের সাথে সাথে অবাক হয়ে দেখলাম তারাও হাসতে জানে, তারাও আইডিটা আগেই না খুঁজে আমায় কেমন আছি জিগেস করে।

এবার বলি তাদের কথা যাদের জন্য ক্যাম্পাস জীবনে নানা বৈচিত্র এসেছে, আমার বন্ধুরা। হাসি, কান্না, ঝগড়া, কূটনামি, সাহায্যে এগিয়ে আসা সব ক্ষেত্রেই তাদের সমান দক্ষতা, সমান গুরুত্ব। কারন এরই নাম হয়ত বন্ধুত্ব। কতবার ভিন্ন মতে বিভক্ত হয়ে বিতর্ক হয়েছে ক্যান্টিনের টেবিলে, অন্য কে ব্যঙ্গ করে চুমুক পরেছে নিদমহলের চায়ের কাপে, গোল হয়ে বসে ত্রুট ডেয়ার খেলায় বিপদে ফেলেছি একে অপরকে, কেও হটাৎ আবেগে কান্না জুরে দিলে সকলে শান্তনা দিয়েছি নানা সুবাক্যে, প্রেজেন্টেশন শেষে শাড়ী পড়া ছবি তোলার মেলা লেগেছে বন্ধুর ডিএসএলারে, কতবার হেসেছি, কাদেছি, স্বপ্ন বুনেছি একত্রে এই ক্যামাসে।

পরিশেষে, বলতে পারি কিছু সমবয়সীর ‘বন্ধু’ ডাক, বন্ধুত্বের টান, ক্যাম্পাসের বড়দের স্নেহ, আদর আর ছোট ভাই বোন গুলোর আবদার মাখা আপু বলা, এই আমার ক্যাম্পাস জীবনের প্রাপ্ত অমূল্য সম্বল। এই চিরসবুজ ক্যাম্পাস চিরকাল সবুজ থাকবে, আমাদের মত কত কত কিশোর এই সবুজের ছোয়ায় তারুণ্যের সংকল্পে মাতবে, যুগে যুগে কত উৎসব আনন্দ হবে এই ক্যাম্পাসে। আমি বুড়িয়ে যাব হয়ত, আমি হারিয়ে যাব হয়ত। তবে ক্যাম্পাস থাকবে চিরযৌবন, ক্যাম্পাস ফিরে পাবে আবার তরুণ্যে ভরা আমি কে, অন্য কোনো সময়ে অন্য কোনো নামে। আমার ক্যাম্পাস চিরকাল আমার হাসিতে মুখরিত থাকবে।

Written by Lutfun Naher Mahmud Oysharja 171-10-1488