প্রতিটা উন্নতি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এবং এই প্রক্রিয়ার কোন শেষ নেই। সময় যত পরিবর্তন হবে উন্নতির চাহিদাও উপরে উঠবে। যদিও এটার কোন শেষ নেই, কিন্তু শুরু আছে। কোন না কোন একটি সময় থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। আমার বাবার কথা বলি। উনি ডিসি অফিসের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা। শিক্ষাগত যোগ্যতা – বি.কম। তিনি নিজের চাকরির পাশাপাশি টেইলরিং এর কাজ করেন। মাঝে মাঝে নিজের হাতে জামা তৈরি করে মাকে উপহার দেন। নিজেদের কোন কিছু ছিঁড়ে গেলে বাবা আমাদের কাছে একটি ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেন। তিনি একজন ইলেকট্রিশিয়ান ও বটে। খুব কম ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র আছে যেগুলো উনি ঠিক করতে পারেন না। এই যেমন কিছুদিন আগে খালামনির গ্রাইন্ডার নষ্ট হয়ে গেল। উনি বাবার কাছে নিয়ে আসলেন ঠিক করে দেওয়ার জন্য। এমন না যে সবগুলোতে প্রথমবারেই সফলতা পান। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টার মাধ্যমে ঠিক হয়ে যায়। উনি বাড়ির ডিজাইন ও করতে পারেন। সেই সাথে জমির সার্ভেয়ার হিসেবেও সার্টিফিকেট নিয়েছেন। জমি মেপে কিছু বাড়তি উপার্জন করতে পারেন যা পরিবারের জন্য খরচ করতে পারেন। বাবার এই প্রক্রিয়া কিন্তু চলছেই। শেষ নেই এই চলার। প্রতিদিনই নতুন কিছু শিখছেন, শেখাচ্ছেন। কিন্তু উনার এই শেখার ইচ্ছাটা একদিন শুরু হয়েছিল। আর এই শুরু হওয়ার মূলে ছিল আগ্রহ এবং পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মেলানোর।

করোনা মহামারী সময়ের কথা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাব ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির দিকেও আমরা বুঝতে পারি নি যে সামগ্রিক ভাবে কতটা পরিবর্তনের দিকে আমরা যাচ্ছি। 

প্রথমে আসি ক্লাস নেওয়ার কথায়। যখনই ঘোষণা আসল পুরো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ তখনই ছাত্র শিক্ষক সকলের মনেই চিন্তা জাগলো তাহলে ক্লাস কিভাবে নেওয়া হবে। প্রথম দিকে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ক্লাস নিয়েছেন। ওই সময়ে ফেইসবুক লাইভ অনেক ছাত্র শিক্ষককে সহযোগিতা করেছে। নিজের কথাতে যদি আসি তাহলে বলব, আমি প্রথমে ফেসবুকে আলাদা সেকশনের জন্য আলাদা গ্রুপ তৈরী করেছিলাম। তারপর প্রতি গ্রুপে ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে টপিক বুঝানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু ছাত্রদের সাথে যোগাযোগটা ঠিকভাবে হচ্ছিল না।  তারপর আমরা পেলাম গুগল মিট এবং জুম এর মত প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে আমরা পুরোদস্তর ক্লাস নিতে পারতাম। যেখানে অ্যাটেনডেন্স নেওয়া যেত, সাধারণ ক্লাসের মত করে লেকচার দেওয়া যেত, ছাত্র শিক্ষকের আলোচনা করা সম্ভব হতো, ক্লাসে যদি কোন স্লাইড পাড়াতাম সেটা গুগল মিট বা জুমের মাধ্যমেও সম্ভব ছিল । জুম তো আরো এক ধাপ এগিয়ে গ্রুপ ডিসকাশন বা “দলবদ্ধ আলোচনা” বিষয়টাকেও সম্ভব করেছিল। যে আমরা এক মাস আগেও বুঝতে পারি নি ক্লাস কিভাবে নিব সে আমরাই প্রযুক্তির কল্যাণে খুব সুন্দর করে ক্লাস নিতে সক্ষম হলাম। 

এতো গেল শুধু ক্লাসের কথা। কিন্তু শুধু অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমেই কি দেশের সকল প্রান্তে থাকা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব? যেখানে আছে নেটওয়ার্কের সমস্যা, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের সমস্যা, কিছু শিক্ষার্থীর কাছে স্মার্টফোন না থাকার সমস্যা। এতগুলো সমস্যা সামনে নিয়ে শুধুমাত্র অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌছানো টা কিছুটা কঠিন তো বটেই। সে ক্ষেত্রে শিক্ষকবৃন্দ সৃজনশীল পদ্ধতিতে এগুলেন। উনারা তৈরি করলেন প্রতিটি চ্যাপ্টারের উপরেই ভিডিও লেকচার। ভিডিও লেকচারে ওই টপিক সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য একজন শিক্ষক তুলে ধরতেন। তাতে ওই ভিডিওর মাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট টপিক সম্পর্কে একটা ভাল ধারণা একজন শিক্ষার্থী নিয়ে নিতে পারত। এবং অনলাইন ক্লাসের আগে সেই ভিডিওটা দেখে আসলে ওই টপিক সংক্রান্ত ক্লাসের আলোচনা আরো ফলপ্রসূ হতো। ছোটবেলায় আমরা দেখতাম আগামী দিন যে চ্যাপ্টার আমরা পড়বো সেই চ্যাপ্টার টি আমাদেরকে পড়ে আসতে বলা হতো যাতে করে ক্লাসের আলাপ-আলোচনা গঠনমূলক হয়। এই করোনাকালীন মহামারীর সময় ভিডিও লেকচার সেই জায়গাটা দখল করে নিল এবং এটার ফলাফল অনেক ভাল আসল।  

এই ভিডিও লেকচার তৈরি করতে গিয়ে অনেক শিক্ষক কিছু সমস্যা অনুধাবন করতেন। আমরা অনেকেই মানুষের সামনে কথা বলতে পারলেও ক্যামেরার সামনে কথা বলতে গিয়ে কিছুটা বেগ পোহাতাম। ধীরে ধীরে অভ্যাসের দরুণ সেই সমস্যাটাও আমরা কেটে উঠেছি। বিভিন্ন ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি আমাদের ভিডিও লেকচারকে একটি পূর্ণাঙ্গ মাত্রা দেয়ার। বিভিন্ন ধরনের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, ছবি, অ্যানিমেশন ব্যাবহার করে আমরা আমাদের ভিডিও লেকচারকে অনেক সুন্দর এবং তথ্যবহূল করতে পেরেছিলাম। এই ভিডিও লেকচার, এডিট এই জিনিসগুলো কিন্তু আমরা করোনার আগেও পেয়েছি কিন্তু নিজের প্রয়োজন হয়নি বিধায় ব্যবহার করিনি। এই করোনা মহামারী আমাদেরকে নিজেদের উন্নতি করার সুযোগ দিয়েছে, সুযোগ দিয়েছে পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার। যারা এই সময়টা সদ্ব্যবহার করেছেন তারা অনেকেই খুব সুন্দর ভাবে তাদের উন্নতি করেছেন যা শিক্ষার্থীদের অনেক সহযোগিতা করেছে। 

মহামারীর সময়ে আরেকটা জিনিস যা আমাদেরকে অনেক বেশী সহযোগিতা করেছে নিজেদের উন্নতি ত্বরান্বিত করতে তা হলো, অনলাইন কোর্স। বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্ম আছে যারা অনলাইন কোর্স অফার করে। যেমন: Coursera, Go Edu ইত্যাদি। তাদের প্লাটফর্মে অনেকগুলো কোর্স থাকে যেগুলো অনলাইনে সম্পন্ন করা যায়। কোর্সগুলোর বিশেষত্ব হলো সেগুলো নিজেদের সুবিধামত সময় সম্পন্ন করা যায় এবং সেগুলো আন্তর্জাতিক মানের হয়। আন্তর্জাতিক মানের লেকচার, কন্টেন্ট ইত্যাদি বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত অনলাইন কোর্সগুলো সত্যিকার অর্থেই অনেক উপকারী ছিল। নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন অনলাইন কোর্স করে ছাত্র এবং শিক্ষকের একটি বিশাল অংশ উপকৃত হয়েছে এই মহামারীর সময়ে। 

মহামারীর সময়ে আমার আরেক বন্ধুর নাম হলো গেমিফিকেশন বা খেলার মাধ্যমে শেখা।  ছোটবেলার পড়ালেখার ধরনের সাথে যদি এখনকার পড়ালেখার ধরন তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে ছোটবেলার বহু ছড়া আমাদের এখনও মনে আছে কিন্তু কিছুদিন আগের পড়া আমাদের মনে নেই। এই পার্থক্যের একটি কারণ হচ্ছে আনন্দ সংযোগ। ছোটবেলায় আমরা যা কিছু পড়তাম সেটার মধ্যে কিছু আনন্দ থাকতো, যা হয়তোবা খেলার ছলে আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়ে দিতে পারতো। এই মহামারীর সময়ে আমি এমন কিছু ওয়েবসাইটের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি যারা খেলার ছলে অনেক টপিক বুঝিয়ে দিতে সহযোগিতা করে। তাতে খেলাও হলো, সেই সাথে শেখাও হলো। শিক্ষকবৃন্দ নিজেদের টপিকের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন গেইমের সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিতেন যাতে করে খেলার মাধ্যমে তারা ওই টপিক সম্পর্কে একটা ভাল ধারনা পেতে পারে।

BLC বা Blended Learning Center এর কথা না বললেই নয়। উপরের সবগুলো বন্ধুর আড্ডাখানা ছিল ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি কতৃক উদ্ভাবিত ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার। বিএলসি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে প্রত্যেক কোর্সের জন্য দরকারী সম্পূর্ন জিনিস এক জায়গায় রাখা যেত যাতে করে শিক্ষার্থীরা এক জায়গা থেকেই সব জিনিস পেতে পারে। এই বিএলসির মাধ্যমে অ্যাটেন্ডেন্স নিতে পারতাম, অ্যাসাইনমেন্ট জমা নিতে পারতাম, শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রেজেন্টেশন জমা দিতে পারত। এগুলোর সাথে, ক্লাস টেস্ট  থেকে শুরু করে মিড-টার্ম এবং ফাইনাল পরীক্ষাও নিতে পারতাম আমরা। সবগুলো জিনিস সাবলীলভাবে সম্পন্ন করতে খুবই সহযোগিতা করেছিল এই প্ল্যাটফর্ম। প্রতি ক্লাসের পরে আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে ডিসকাশন ফোরাম ব্যবহার করে ক্লাসের নির্দিষ্ট টপিকের উপরে মতামত জানতে চাইতাম। পরবর্তীতে নিজেদের মতামত দিয়ে শিক্ষার্থীদের ধারনা আরো গঠনমূলক করতে পারতাম। শিক্ষার্থীরা প্রতি ক্লাসের উপর ফিডব্যাকও দিতে পারত যাতে করে শিক্ষকবৃন্দ নিজেদেরকে আরো সুগঠিত করতে পারতেন।

সর্বোপরি আমার করোনা-কালীন বন্ধুরা আমাদের অনেক কিছু জানিয়েছে, অনেক কিছু শিখিয়েছে। এবং এই চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা সামনে আরো ভাল কিছু করার আশা রাখতে পারি।