ডিজাইন পেশায় যারা নিয়োজিত তাদের একটি কমন চিন্তার বিষয় হল ক্লায়েন্ট সেটিসফেকশন। ২০০০ সাল থেকে অদ্যাবধি ডিজাইন পেশায় আছি, কিছু অভিজ্ঞতার সঞ্চার হয়েছে। এই বিষয়ে আমার কিছু ছাত্র আমাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে- স্যার ক্লায়েন্টের মন বুঝবো কিভাবে? এই অভিজ্ঞতাগুলো একবারে এক লেখায় বলা সম্ভব নয়, তাই পর্ব আকারে লিখব ভেবেছি।

ক্লায়েন্ট ডিলিংস- ১ (লোকাল ক্লায়েন্ট)

সময় তখন ২০০৯-১০ মেইল পাঠানোর অভ্যাসটা খুব বেশী ছিল না । ক্লায়েন্টরা পছন্দ করত সরাসরি কালার প্রিন্ট দেখতে, তাই হল । ঝকঝকে তকতকে কালার প্রিন্ট নিয়ে বান্দা হাজির ক্লায়েন্টের দরবারে । এই অফিসে আমার যোগাযোগ এম ডি স্যার সঙ্গে – দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর যথারীতি সাক্ষাৎ।

এম ডি স্যারঃ কি ডিজাইন করেছেন দেখি?(এরোগেন) 

বিজ্ঞাপনী সংস্থায় প্রচলিত একটা কথা আছে “The client is the second god ” বুঝতেই পারছেন কতটা নমনীয় আমি।

আমিঃ স্যার এই যে – A4 খাম থেকে বের করে ডিজাইনটা সামনে দিলাম। 

খুব বিশেষজ্ঞের মত করে দেখছেন এমডি স্যার, একবার ঘাড় টা ডান দিকে আরেকবার বাম দিকে কাত করে। কলম আর নোটবুকটা নিয়ে ওঁৎপেতে আছি আমি, মনে হচ্ছে আজকের প্রেসক্রিপশনটা বেশ বড় হবে। তারমানে অনেকগুলো এডিট /ইন্সট্রাকশন আসতে পারে। সাথে সাথেই বড় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন এমডি মহাশয়, সাথে একটা মুখ চিপিয়ে হাসি। ততক্ষণে আমিও নিঃশ্বাসটা ছাড়লাম অনেকক্ষণ চেপে রাখার পর। যাক মনে হয় পছন্দ হয়েছে ডিজাইনটা। পাশ থেকে এক চামচা  (অ্যাসিস্ট্যান্ট ) বলল স্যার কালারটা কেমন জানি হইসে, লাল ওইলে ভালো ওইত না? কথার ভাবে মনে হল ডিজাইনের উপর তাঁর বড্ড বেশি দখল আছে। জানতে পারলাম সে নাকি পিয়ন, চায়ের কাপ নিতে এসেছেন ফাঁকে বাঁসটা মেরে দিল আমার।

এমডি কনফিউজ- আশিক আর একটু দেখেন, লাল জাতীয় কিছু যুক্ত করে কিছু করা যায় কিনা ? অথচ কোম্পানির গাইডলাইনে লালের ছিটেফোটাও নেই।

একদিন পর-

আবার বান্দা হাজির হলাম! ক্লায়েন্ট বলে কথা। না গেলে ত ক্লায়েন্ট থাকবে না। আজকের ডিজাইন এ পরিমিত লালের ব্যবহার আছে। আজ তো কথা থাকার কথা নয়। এটা ছিল আমার ভাবনা।

এম ডি: দেখি কি করেছেন?

আমি: এই যে স্যার (A4 পেপারে কালার প্রিন্ট দিয়ে বললাম)

এম ডি: চা খাবেন ?

আমি: না (কারণ চা খেতে চাইলে তো ওই চামচটা আসবে, তাই চা খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বাদ দিলাম)

আমি: স্যার ডিজাইন টা কেমন হলো?

এম ডি: ভালো … বাট লাল টা কেমন যেন লাগছে….. (আজকেও কনফিউজ মনে হচ্ছে)

হুট করে রুমে ঢুকে পড়ল হেড অফ মার্কেটিং ম্যান, আমার সাথে কুশল বিনিময় হলো তার সঙ্গে। আমার পাশের চেয়ারে বসেছেন।

এমডি: হেড অফ মারকেটিং কে বলল- দেখতো ডিজাইন টা।

হেড অফ মারকেটিং দেখেই বিরক্তিকর একটা চেহারা করে বলল- স্যার লাল কেন? এটা তো আমাদের ব্র্যান্ড গাইডলাইনে নেই। আমরা তো ব্র্যান্ড গাইডলাইন এর বাইরে যেতে পারব না।

এমডির মুখটা একটু মলিন করে বলল- অবশ্য আমি লাল দিতে বলেছি, উনি আর একটা ডিজাইন করেছিলেন।

হেড অফ মারকেটিং বললেন- স্যার ওটা দেখি। আমি ব্যাগ থেকে বের করে দেখালাম।

হেড অফ মার্কেটিং: স্যার এটাই তো ঠিক আছে, উনি তো বুঝেই করেছেন মনে হচ্ছে।

আমি বললাম – জী- আমি গাইডলাইন ফলো করে কাজ করেছি।

এমডি বললেন – ওকে ! তাহলে ওটাই ফাইনাল।

অবশেষে অফিস থেকে হাঁসিমুখে প্রস্থান।

আজকের ঘটনায় কয়েকটি শিক্ষা ;

১. ক্লায়েন্টের অফিসের পরিবেশও আপনার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

২. নিয়ম মেনে ডিজাইন করলে আপনি জয়ী হবেন।

৩. পছন্দের জন্য একাধিক অপশন দিতে পারলে ভালো, ক্লায়েন্টকে মূল্যায়ন করা হয়- তাতে ক্লায়েন্ট খুশি হয়।

৪. যদি ব্র্যান্ডেড কোম্পানি না হয় তবে অফিসে বসের আশপাশে সাপোর্টার তৈরি করুন কাজে লাগবে।

৫. প্রথমেই নিজের পাণ্ডিত্য দেখানো যাবে না -তাহলে আপনার সাথে ক্লায়েন্টের কেমিস্ট্রি নাও হতে পারে (ব্যাপারটা সব ক্লায়েন্টের জন্য প্রযোজ্য নয়)। 

৬. তাকে সম্মান দিয়ে দ্বিতীয় কাজটি না করলে তার মধ্যে অপরাধবোধ টা হতো না।

৭. ডিজাইন করার পাশাপাশি ক্লায়েন্টকে বুঝতে পারা ও বড় ধরনের দক্ষতা ।

ক্লায়েন্ট ডিলিংস -২ (লোকাল ক্লায়েন্ট)

বিজ্ঞাপনী সংস্থার ক্রিয়েটিভ সেকশনের সাথে ক্লায়েন্টদের খুব বেশি মেশার সুযোগ থাকে না । মালিকপক্ষ এটাকে থ্রেট হিসেবে চিহ্নিত করে- কারণ ক্লায়েন্টের সাথে ক্রিয়েটিভ লোকদের যোগাযোগে ক্লায়েন্ট হারানোর সম্ভাবনা থাকে । এরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে, তাই এখানে মিডেল ম্যান হিসেবে কিছু মানুষ কাজ করে, যার কাজ হচ্ছে ” ক্লায়েন্ট সার্ভিস” ।

ছাত্র অবস্থায় ফুলটাইম চাকুরী সম্ভব নয় বলে নিজেই একটা এজেন্সি, তার মানে আমি নিজেই “Jack of all trades, master of Design” যাইহোক কাঁচা হাতে সবকিছু একাই সামাল দিতে হতো । একাউন্টস, মার্কেটিং , ক্লায়েন্ট সার্ভিস, ডেলিভারি ম্যান থেকে ক্রিয়েটিভ অল ইন ওয়ান ম্যান ।

এটাও ২০০৯ এর ঘটনা , দিন ক্ষণ ভুলে খেয়েছি । এই ক্লায়েন্টটা ছিল একটু পণ্ডিত কিসিমের । কোন কিছু বোঝাতে হলে প্রচুর লেখাপড়া করতে হয় । আমি নিজেও অনেক কিছু শিখেছি এই ক্লায়েন্ট এর কাছ থেকে ।

যাই হোক আসি মূল কথায় । একটা প্যাকেজিং এর ডিজাইন নিয়ে আলোচনা । আমার লাইফ এ অসংখ্য প্যাকেজিং করার সৌভাগ্য হয়েছে । এই ডিজাইন টা ভাল কাজ গুলোর মধ্যে একটা । কিন্তু পণ্ডিত ক্লায়েন্ট কে পছন্দ করাতে অবস্থা খারাপ । একবার এই কালার তো আরেকবার অন্যটা, বোঝা মুশকিল আসলে সে কি চায়? ওই দিন বুঝেছিলাম ডিজাইন শুধু আমার মনে ধরলে হবেনা, ক্লায়েন্ট এর বেপারটা একটু আলাদা । প্রতিটা ক্লায়েন্ট এর ট্রিটমেন্টও আলাদা । মনোনিবেশ করলাম কালার নিয়ে পড়ালেখায় । এবার আসো পন্ডিত মামা (ক্লায়েন্ট) ।

তার চাহিদা মত ডিজাইন করে পুনরায় সাক্ষাৎ । দুটো ডিজাইন পাশাপাশি রেখে বললাম ভাই দেখেন কোনটা ভালো লাগছে ?কনফিউজ ! তাঁর দেয়া ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী করা ডিজাইন টা এপ্রুভ করার কোনও জো নেই কারণ- দুটো ডিজাইনের তফাতটা “কোথায় আব্দুল আলী আর কোথায় জুতার কালি” আমি বললাম আপনার ডিজাইন পছন্দ করতে হবে না । বলল কেন ? কারণ আপনি নিজে জয়ী হতে চাচ্ছেন।

ক্লায়েন্টঃ তার মানে ?

আমিঃ মানে হল আপনি আপনার ইন্সট্রাকশন এ করা ডিজাইন টা এপ্রুভ না করলে নিজেকে পরাজিত ভাবছেন ।

আমি আপনাকে দুটো অপশন দিলে যেকোন একটা অপশন আপনাকে বেছে নিতে হবে

ক্লায়েন্ট ঃ কি সে অপশন ?

আমিঃ অপশন ১- আমার পছন্দের ডিজাইনটা অনেক ভেবেচিন্তে করা হয়েছে এবং প্যাকেজিং এ ব্যবহৃত কালার গুলো কিভাবে একজন কাস্টমারকে আকৃষ্ট করবে, তার কালার সাইকোলজিকাল ইমপ্যাক্ট কি বুঝিয়ে দিলাম এবং এই ডিজাইন টা এপ্রুভ করলে মার্কেটে কি ইমপ্যাক্ট হবে তার একটা স্ট্যাটিসটিকস দেখিয়ে বললাম- এটা কোম্পানির জয় হবে, আমার নয় ।

অপশন ২– নিতান্তই আপনার পছন্দের অথবা রুচির প্রাধান্য পাবে এর কোন ইম্প্যাক্ট কাস্টমার এর উপর পড়বে না । সিদ্ধান্ত আপনার ।

অবশেষে মামা ( ক্লায়েন্ট) আমার সারিতে এসে অবস্থান নিলেন ।

এক বছর পর-

আশিক ভাই! আপনার ওই ডিজাইন এর প্রোডাক্ট টা এত সেল যে-

আমার ফ্যাক্টরির প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি বাড়াতে হচ্ছে । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এত ভালো একটা ডিজাইনের জন্য ।

আজকের শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

১. শুধু ডিজাইন করলে হবে না তা নিয়ে একটু পড়াশোনা করতে হবে।

২. যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করতে পারলে আপনার ডিজাইন অ্যাপ্রুভ হবেই।

৩. প্যাকেজিং ডিজাইনের ক্ষেত্রে মার্কেট এনালাইসিস করতে হবে।

৪. যেহেতু প্যাকেজিং- তাই সেলস ইম্প্যেকট ও কাস্টমার সাইকোলজি বাদ দেয়া যাবে না ।

৫. ক্লায়েন্টের কাছ থেকে শিখার কিছু থাকলে অবশ্যই নিতে হবে । 

৬. ক্লায়েন্টকে তার লাভটা বোঝাতে পারলে দ্বিমত থাকার কোনো কারণ নেই।

৭. ডিজাইন করতে যে সময় ব্যয় করবেন তার চেয়ে বেশি সময় দিন তা পর্যবেক্ষণে এতে ত্রুটি গুলো বের হয়ে আসবে ।

(চলমান)

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই মতামতগুলো আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন মাত্র । ছবি- ইন্টারনেট । 

লেখকঃ মীযানুর রহমান , জৈষ্ঠ প্রভাষক

মাল্টিমিডিয়া এন্ড ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি